এতাতী পরিবারের এক বোনের জীবন বৃত্তান্ত তার নিজের লিখায়৷
এতাতি কেমন হয় দেখুন তার লিখায়!
আমার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আমার বয়স ছিল সারে পনের বছর, সদ্য এস এসসি পরিক্ষা দিয়েছি । তখনও রেজাল্ট বের হয়নি । পরিক্ষা শেষ ! স্বাধীন !! পড়াশুনার কোন চিন্তা নেই তাই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতাম । কিন্তু এই স্বাধীনতা আর বেশিদিন থাকল না। আম্মু এসে বলল তোকে দেখতে আসবে তুই একটু রেডি হয়ে নে । আমি কথাটা শুনেই কান্না করতে করতে আম্মুকে বললাম আমি কলেজে উঠব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ব , আমার কত্ত স্বপ্ন আছে আর তোমরা সেগুলো সব শেষ করে দিবে , নাকি মেয়ে বলে তোমরা আমাকে বোঝা মনে কর তাই আপদ বিদায় করছ ?
কথাটা শুনে আম্মুও কেঁদে ফেললেন ।
আমার আব্বু একজন খুবই ধার্মিক মানুষ তাবলীগ করেন । বেশ কয়েকটা দেশে চিল্লাও দিয়েছেন । প্রতি বছর উমরা করেন ।
আব্বু এসে বললেন "শুনো মা ! আমি সব সময় তোমাদেরকে আমার জান্নাত মনে করি কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামতো মেয়েদের ব্যাপারে এমনটাই বলেছেন । জান্নাতকে কখনও কেউ বোঝা করে বলো ?
আর যে ছেলেটার সাথে তোমার বিয়ে দিতে চাচ্ছি তাকে আমি ছোট থেকেই মনে মনে পছন্দ করে রেখেছি আমার তিন মেয়ের কোন একজনকে দিব । এটা তোমার ভাগ্য যে তিনজনের মধ্যে তুমিই উপযুক্ত হয়েছ তার জন্য । বললাম আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে তুমি বলে দাও আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে ।
আব্বু বললেন কেন অপেক্ষা করতে বলব ; ওরা কি তোমাকে আগে থেকে পছন্দ করে রেখেছে, নাকি ওরা প্রস্তাব দিয়েছে ? ছেলেটা বিবাহ করবে শুনে আমিই প্রস্তাব দিয়েছি । বয়স মাত্র বিশ বছর সবে মাওলানা শেষ করল ...
আব্বুকে অনেক ভালবাসি তাই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম আর ছেলেরও পছন্দ হয়েছে আমাকে...
বাসর ঘরে বসে আছি আর ভাবছি টিভিতে দেখেছি মেয়েদের বাসর কত্ত সুন্দর হয় চারপাশে ফুল দিয়ে সাজানো থাকে বিছানায়ও ফুল থাকে মেয়েটা ফুলের মধ্যে বসে থাকে আরও কত্ত কি ...
কিন্তু আমি বসে আছি মশারির মধ্যে ।
মানুষের বিয়েতে গায়ে হলুদ তেলোই মেলোই নানা রকম আনন্দ ফুর্তি হয় সে সবতো কিছুই হলো না । আর এগুলো না হওয়ারই কথা কারণ আব্বু বলেন এগুলো মুসলমানের শান না ।
বিভিন্ন ধরনের কথা ভাবছি আর খুব ভয় পাচ্ছি । কিন্তু কেন ভয় পাচ্ছি তা জানি না ,খুবই অস্বস্তি আর বিরক্তবোধ করছিলাম ।
কিছুক্ষন পর রুমে সালাম দিয়ে ঢুকল, কপালের সামনের চুল ধরে দোয়া পড়ল ...
বিভিন্ন নসিহত করতে লাগল যা আজও আমার কানে বাজে ( কয়েকটা উল্লেখ করি )
" শুনো আমরা অনেকেই বিবাহ করি প্রাকৃতিক কারণে এবং মা ও বাবা হই প্রাণী জগতের সাড়া দিয়ে । শুনতে কষ্টকর হলেও এটাই সত্য এবং এটাই তিক্ত সত্য ।
মহৎ কোন চিন্তা ও চেতনাকে সামন রেখে , উম্মাহর সুসমৃদ্ধি ও বিস্তারের মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পবিত্রতার ছায়ায় দাম্পত্য জীবন অর্জন করা উচিত । ভালো করে মনে রাখবে মাতৃত্ব যদি হয় শুধু প্রসববেদনার নাম, পিতৃত্ব যদি শুধু... তাহলে প্রাণী জগতের পিতা-মাতা আর মানব পিতা-মাতার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই ।
একজন সুস্থ মস্তিষ্কের নারী কখনও তার সৌন্দর্য প্রদর্শণ করে রাস্তায় বের হয় না বরং পর্দায় আবৃত থাকাই তার আভিজাত্য ।
মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে অনেক সময় লাগে কিন্তু ভেঙ্গে যেতে এক মূহর্তও সময় লাগে না ...
(কথাগুলো এখনও আমার জীবন পথের পাথেয় হয়ে আছে)
কথাগুলো শুনে তখন মনে খুব ভালবাসা জন্ম নিল খুব দেখতে ইচ্ছে করল ; তাঁর দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলি । আবার তাকালাম আবার হল ,আবার তাকালাম আবারও ... বেশ কয়েকবার এমন হল । পরে বলল আচ্ছা আমি চোখ বন্ধ করি তুমি তাকাও...
বিয়ের এক সপ্তাহের পরই মোঃপুরে দুই রুমের একটা বাসা ভাড়া করে চললাম নতুন এক জীবনের দিকে । রান্না বান্না বলতে কিছুই করতে জানতাম না । কিভাবে মাছ মাংস কাটে তাও জানতাম না । কোন অংশ খায় আর কোন অংশ ফেলে দেয় তাও জানতাম না । আম্মুর কাছ থেকে ফোন করে করে জানতাম । তিনি বাসায় আসলে ইউটিউবে সার্চ দিতাম কিভাবে মাছ, মাংস কাটতে হয় , রান্না করতে হয় 😇😇😇
রান্না খেয়ে বলত বাহ্ অনেক চমৎকার হয়েছে এজন্য এর পুরস্কার হিসেবে তোমাকে শুক্রবার ঘুড়তে নিয়ে যাব । তাঁর প্রশংসা আর উৎসাহ শুনে তখন সত্যিই নিজেকে খুব ভাল মানের একজন রাধুনি মনে করতাম । আসলে আমি এতটাই দক্ষ রাধুনি ছিলাম মাছ মাংসের কোন অংশ খায় না খায় এই সন্দেহে বড় বড় মাছেরও মাথা ফেলে দিতাম আর মুরগির মাংসটুকু ছাড়া সবই ফেলে দিতাম ।
এরই মধ্যে রেজাল্ট বের হল A+ পেয়েছি শুনে খুব খুশি হলাম আর মনে মনে ভাবলাম তিনি কি আমাকে কলেজে ভর্তি করবে ? একজন আলেমের বউ এভাবে কলেজে পড়বে তিনি কি মানবেন । কলেজে ভর্তির কথা বলব কি বলব না খুব চিন্তায় ছিলাম
একদিন এসে বললেন:
তোমার বাবা বলেছেন তুমি নাকি পড়াশুনার প্রতি খুব মনোযোগী । তাহলে তোমার দ্বারাই কাজ হবে আর তোমার ব্রেন্ডও ভাল আছে তাহলে আমার আশাটা পূর্ণ হবে ...
( মনে মনে খুব খুশি হলাম মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি )
তবে কোন কলেজ ভার্সিটিতে না বরং তোমাকে আমি এমন এক জিনিস উপহার দিব তা তুমি কখনও ভাবতে পারবে না ।
একদিন মাগরিব পর ফুচকা আনল দুজনে খাচ্ছিলাম তখন আমাকে বলল "আচ্ছা আমাকে তুমি একটা সূরা শুনাও তোমার যেটা ইচ্ছা হয় "
আমি খুব লজ্জা পাই অনেক বলতে বলতে সূরা ফাতিহা শুনাই ।
বাহ তোমার কন্ঠতো অনেক সুন্দর । মেয়ে মানুষ তো তাই হয়ত ঠিক না ...
আমি মনে মনে খুব খুশি হলাম । লজ্জায় মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি 😊 হাসছি । পরে আবার বললেন
আচ্ছা তুমি কি আমাকে সূরাটা আবার শুনাবে এবং সাথে আরও দুটো সূরা যাতে আমি রেকর্ড করে রাখতে পারি । আমি চোখ বন্ধ করে শুনাই আর তিনি ভিডিও করে রাখেন ।
পরের দিন সন্ধায় একটি কয়দা এনে বলল "শুন ভালোরও একটা ভালো আছে , তোমার পড়া , কন্ঠ , লাহান সবই সুন্দর তবে একটু শুদ্ধ হলে আরও ভাল হবে"
শুরু হল এক নতুন অধ্যায় ! আরবী হরফের মশক করাচ্ছে । মুখ হা করতে বলে তারপর তার আঙ্গুল দিয়ে বলে এই হরফটা দাতের এখানে লাগবে এটা সেখানে লাগবে। কিন্তু আমার কাছে খুবই লজ্জা লাগত । মাথা নিচু করে মাথা বালিশের ভিতর গুজে রাখতাম । তিনি কিছু বলতেন না ।
এভাবে কিছুদিন করার পর লজ্জা ভেঙ্গে গেলেও চোখ খুলতাম না বরং বন্ধ রেখেই মশক করতাম ।
উচ্চারণ সহীহ হল তাজবীদগুলোও মুখস্থ করার পর নাজেরা তারপর শুরু হল আরেক জীবন । মুখস্থ করতে বলল । কিন্তু মুখস্থ কি এত্ত সোজা । আমি স্কুল জীবনে ২৫ টিরও বেশি বড় বড় ইংলিশ রচনা মুখস্থ করেছি , এখনও মুখস্থ আছে । কিন্তু কুরআন মুখস্থ করতে গেলে ঘুম আসে শরীর খুব ক্লান্ত লাগে ।
কিন্তু তিনি হাল ছাড়তেন না । বরং বাচ্চাদের মত আদর করত মাথায় হাত বুলিয়ে দিত ঘুরতে নিয়ে যেত । এভাবে ৩০ নাম্বার পারা মুখস্থ হলে খুব আনন্দ লাগল ।সেও আমার সাথে তাল মেলাতে লাগল মিষ্টি আনল ঘুরতে নিয়ে গেল আসলে এগুলো ছিল তার উৎসাহ দেয়া । সাত দিন পর আরও চার পারা মুখস্থ হলে আর ভাল লাগল না । কিছুতেই মুখস্থ করতে মন চাইত না ।
যখন আট পারা হয়েছে তখন আল্লাহ তায়ালা এক নেয়ামত দান করেন । কেনসেপ করি । খুব ইচ্ছা ছিল বাচ্চা হওয়ার আগেই হাফেজা হব কিন্তু সেই ইচ্ছা আর পূরণ হল না । তিনি বলতেন এখন মুখস্থ করতে হবে না বরং আগেরগুলোই তেলাওয়াত কর , বেশি বেশি তেলাওয়াত করলে শয়তান আমাদের সন্তানকে কোন আছর করতে পারবে না ।
এই সময় কত্ত কষ্ট হয় তাতো আপুরা জানই তারপরও মুখস্থ করতে থাকি । ২২ পারা হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরই আর রক্ষা হল না, আল্লাহ আমাকে একজন সুস্থ সবল সুন্দর একটি সন্তান দান করেন ।
বাবুর যখন তিন মাস বয়স তখন বাকি ৮ পারা শেষ হয় । খুশি কাকে বলে সেটা হাফেজা না হলে বুঝতাম না ।কে দেখে আমার খুশি , তিনি বাসায় আসলে খুব জোড়ে জড়িয়ে ধরি । এতই খুশিই ছিলাম যে তার বুক চোখের পানিতে ভিজিয়ে দিয়েছিলাম । মানুষ যে খুশিতে কাঁদে সেটাও বুঝলাম ।
( কিন্তু এত সুখের পরও আমার সংসারে নামে এক কালো ছায়া , আসলে সুখের পরে দুঃখ আসে ! আচ্ছা এটা পরেই বলি )
আমি হাফেজা হয়েছি শুনে আব্বু আম্মু বড় ভাইয়া দুই বোন, ভাবি , তিন চাচা এবং ছোট মামা আসেন । কেউই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না । আসলে কি আমার বংশে আমিই হলাম প্রথম কেউ যে হাফেজ । ছোট ভাইও হাফেজ তবে সে তিন বছর আগে হয়েছে ।
অবসর সময় ইউটিউব থেকে হাফেজ ইদ্রিস আল-হাসেমী এবং তহা আল-জুনায়েদ এই দুইজেনর তেলাওয়াত শুনি তাদের কন্ঠও হুবহু নকল করতে পারি । বাংলায় সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন । শুনলে আসলে পাগল পারা হয়ে যাবেন এত্ত চমৎকার কন্ঠ ওদের । কয়েকদিন পর আমার হাজবেন্ড বলল "কুরআন মুখস্থ করেছ এবার কুরআনের ভাষাটা শিখবে না ? হাদীসের ভাষা শিখবে না ?
আমি খুশি মনেই রাজি হয়ে যাই । শুরু হল জীবনের আরেক ধাপ । চলছে চলছে কিছুদিন পর আল্লাহ আরেক নেয়ামত দান করেন । কনসেপ করি । গর্ভকালীন সব সময় কুরআন তেলাওয়াত করতাম যাতে বাচ্চাকে শয়তান আছর না করতে পারে । খুব সুন্দর কিউট একটা সুস্থ সবল সন্তান হয় ।
ভালই দিন যাচ্ছিল ! এরপর সংসারে আসলো এক কালো ছায়া 😥😥😥 !! যাকে বলে সুখের পরে দুঃখ আসে ।
তাবলীগ নিয়ে বিশ্বব্যাপি দুটি দল তৈরি হল সাদ গ্রুপ আর আলেম গ্রুপ । আব্বু , তিন চাচা , মামা, এবং বড় ভাই এরা হল সাদ গ্রুপ । আমার আর বড় বোনের হাজবেন্ড হল আলেম গ্রুপ । যদিও বড় বোনের হাজবেন্ডকে নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই সব ব্যাথা আমার জনকে নিয়েই । তারও একটা কারণ আছে , বড় বোনের হাজবেন্ড আলেম না ।
এই মতপার্থক্য যে এতবড় রূপ নিবে কেউই জানতাম না । আমাকে কলা-কৌসলে বাবার বাড়ি নিয়ে যায় । এবং স্বামীকে ডিভোর্স দিতে বলে । তার কারণ একটাই যদি সে তাদের সাথে যোগ দেয় তাহলে আমাকে যেতে দিবে আর না হয় আমাকে আরেক জায়গায় ভাল ছেলে দেখে বিবাহ দিবে । ওই ভন্ড ছেলের সাথে আমাকে কিছুতেই আর ফেরত দিবে না । যোগাযোগ সব বিচ্ছিন্ন বাসায় একটা ফোন রাখে নাই এমনকি বাহিরে যাওয়ারও সুযোগ নেই কারণ বাহির থেকে তালা মারা থাকত । রাতে ভিতর থেকে তালা মারা থাকত ।
দাবি শুধু ওই একটাই ! খুব কাঁদতাম । এরই মধ্যে আরেক নেয়ামত লাভ করি ।
আমি গর্ভবতি শুনে মনে হল আব্বু তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে । আমাকে বাচ্চাটা নষ্ট করার জন্য কঠোরভাবে আদেশ দেয় । শুনেতো আমার মাথায় আগুন ধরে গেল মনে হল , বললাম "এটা কি জারজ বাচ্চা যে নষ্ট করে ফেলব , নাকি আপনার অনুমতি লাগবে কখন বাচ্চা হবে , না হবে । আমার বাচ্চা আমি কি করব না করব এর অধিকার আপনি দেখাতে আসবেন না"
ওই দিকেরও কোন খোজ খবর নেই সেও কোন যোগাযোগ করতে পারছিল না । বাসায় কয়েকবার আসলে নিচ থেকেই অপমান করে পাঠিয়ে দিত ।
একদিন সন্ধায় আব্বু , তিন চাচা , বড় ভাই আর মামা একটা ছেলেকে নিয়ে আসে আমাকে দেখাতে । ছেলেটা আগে থেকেই রাজি ছিল কিন্তু আমাকে দেখে তার আগ্রহ যেন আরও কয়েকগুন বেড়ে গেছে । সে আমার দুই সন্তান ও গর্ভের বাচ্চাও মেনে নিবে বলে ওয়াদা দিয়ে গেছে ।
ছেলেটা চলে গেলে আমি বললাম তোমাদের এই স্বপ্ন কখনই পূরণ হবে না । আমি জীবনেও আমার স্বামী ছাড়া অন্য কারও কাছে যাব না । কথাটা শুনে বড় চাচা এমন এক গালি দেয় যেটা কখনই আশা করিনি কেউই আশা করেনি । লজ্জাজনক এক ভাষা । এখানে লেখারও হিম্মত নেই আমার ।
খুব কাঁদতাম আম্মুরও কিছু করার ছিল না ভাবিও অসহায় । বড় বোনের হাজবেন্ড আলেম গ্রুপ তাই তারাও এ বাসায় নিষিদ্ধ ।
একদিন সন্ধায় আব্বু বাসায় আসলে আমার বড় সন্তানটা নানা নানা বলে জড়িয়ে ধরে খুব জোড়ে এক চড় মারে । এখন ওর সাত বছর বয়স চলে এমন একটা চড় এখন পর্যন্ত আমিও মারিনি ওর বাবাও মারেনি । কারণ এমন কোন কাজ করে না যার জন্য বকা দিতে হবে , এটা আল্লাহর এক বিশেষ রহমত । হয়ত সেই সময় কুরআন পড়ার কারণে এটা দান করেছেন ।যাইহোক বাচ্চাদের মারলে চিৎকার দিয়ে কাঁদবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু ও চিৎকার না দিয়ে গালে হাত দিয়ে আব্বুর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আর দুই গাল বেয়ে পানি ঝড়ছে । তখন আমার কলিজাটা মনে হল ছিড়ে গেছে । ওকে জড়িয়ে ধরে নিরবে অশ্রু ঝড়াতে লাগলাম । আর দোয়তো করেই যাচ্ছি ।
প্রায় দের মাস হয়ে গেল নতুন এক ফন্দি করলাম কিছুদিন চুপ হয়ে গেলাম ।
মেডিকেল চেকাপ করতে হবে বলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বললাম । বড়ভাই সাথে যাবে শুনে বললাম আপনার লজ্জা করে মহিলাদের বিষয়ে আপনি নাক গলাচ্ছেন । আমার সাথে আফিফা (ছোট বোন) যাবে ।
বাচ্চাদের বাসায় রাখতে বললে বললাম "ওদের বাসায় রাখলে আপনারা খুন করে ফেলবেন না এটার কি নিশ্চয়াতা ? সেদিন তো একজন এমন চড় দিছে যেটা বড়ড়াও সহ্য করতে পারবে না ।
দুটো সিএনজি নিলাম একটায় বড় ভাই আর আব্বু আরেকটায় আমরা তিনজন আর ছোট বোন । ড্রাইভার ভাইয়ের কাছ থেকে ফোন নিয়ে বললাম আমি আসছি বলে বের হতে বললাম । তোমার সাথে তোমার বন্ধুদের সাথে নিতে বললাম সাথে আব্বু বড় ভাইয়া আছে সেটাও বললাম ।
ড্রাইভার ভাইকে বললাম যে তারা আমাকে জোর করে আমার বাচ্চাটা নষ্ট করতে চায় কারণ তাদের কথা দুটি সন্তানের বেশি সন্তান ভাল না তাই আমার বাচ্চাটা নষ্ট করতে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে । কথাটা শুনে লোকটা রেগে বলল কয়টা বাচ্চা হইবে না হইবে এইডা বাপে কওয়ার কেডা...
আমার দেয়া ঠিকানায় লোকটা চলে আসছে পথে ওই সিএনজিটা বাধা দেয়ার অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু তার বিভিন্ন পথ জানা থাকায় কিছুই করতে পারেনি ।
গাড়ি থেকে নেমে দেখি উনি দাড়িয়ে আছেন । এত্ত এত্ত প্রশান্তি অনুভব করেছি, এত্ত এত্ত খুশি হয়েছি যেদিন হাফেজা হয়েছিলাম সেদিনের মত । আমি কেঁদেই ফেললাম কত দিন পর মুখটা দেখলাম । বাচ্চারা খুব খুশি আব্বু আব্বু করে কোলে উঠেছে আমার খুব ইচ্ছা হল ওকে জড়িয়ে ধরার জন্য মনে হল হারানো সম্পদ খুজে পেয়েছি।
আব্বু এসে বলল চল বাসায় চল । আমি বললাম যদি আপনি জোড়াজুড়ি করেন তাহলে আমি চিৎকার দিয়ে মানুষ জড়ো করে বলব আপনি ইভটিজিং কারি । এতে আমার কোন খারাপ লাগবে না । বরং আরও ভাল লাগবে যদি গণধোলাই দেয় ।
আব্বু আমাকে জীবনেও মেয়ে বলে পরিচয় দিবে না বলে চলে গেল ।
বাসায় এসে মনে হল আমি আমার রাজত্ব ফিরে পেয়েছি । মরুভূমিতে হারানো উটকে খুজে পেয়েছি । তার কোলে মাথা রেখে কানে কানে সুসংবাদটা দিলাম । ওদের সাথে খেলার আরেকজন সাথি আসছে শুনে খুব খুশি হয়েছে । বাচ্চারাও খুশি বাবাকে পেয়ে । প্রায় দের মাস পর শান্তিমত একটু ঘুমাতে পারলাম ।
আমার তৃতীয় বাচ্চাটার মুখের দিকে যখন তাকাই তখন নিজে নিজে খুব ভেঙ্গে পড়ি ; নিষ্পাপ বাচ্চাটা আজ কোথায় থাকত যদি তাদের কথা শুনতাম , কি হত ওই দুই বাচ্চার । বড়জনের দিকে তাকালে মনে পড়ে ঐ চড়টার কথা ,তখন পরম মমতার সাথে চুমু একে দেই ওর কোমল দুই গালে । বরের দিকে তাকালে মনে পড়ে সেই গালিটার কথা তখন সোহাগ নিয়ে আস্তে করে জড়িয়ে ধরি খুজে বেড়াই তাঁর বুকের মাঝে একটু শান্তি । ভুলে যেতে চাই সেই অতীতগুলো । কিন্তু অতীতই আমাকে ভুলতে চায় না ।
কেন জানি ছোটবাচ্চার আম্মু ডাকটা খুব মধুর লাগে । বড়জনের বয়স সাত বছর চলে ১৮ পারা মুখস্থ করিয়েছি । দ্বিতীয়জনকে ৩০ নাম্বার পারা মুখস্থ করিয়েছি । যদিও ও এখনও সবব হরফ উচ্চারণ করতে পারেনা তবুও ওর তোতলা তোতলা পড়াটা শুনতে খুবই ভাল লাগে ।
বাবার সাথে কোন যোগাযোগ নেই এজন্য কোন খারাপ লাগে না এটাই সত্যি ।
বয়স মাত্র সারে ২৩ বছর এর মধ্যে অনেক কিছু পেলাম আবার অনেক কিছু হারালামও ।
বাবা, ভাই, চাচা , মামাসহ আত্মিয়স্বজন । তবে যারা সত্যিকারের আত্মিয়স্বজন তারা ঠিকই খোজ খবর রাখে । তবে যেটা হারালাম এটাকে আপনারা হারানো বলবেন কিনা জানিনা তবে আমার কছে হারানো মনে হয় না । অর্জনের দিকে তাকালে বর্জনের কথা ভুলে যাই । বুকের মধ্যে ত্রিশ পারা কুরআন , তিনটি বাচ্চা , একজন প্রাণের মানুষ , কিছুদিন পর আরেক নাম যোগ হবে "আলেমা"
পুরো ত্রিশ পারা কুরআন বাংলায় বুঝতে পারি অসংখ্য মাসআলা মুখস্থ , হাদীস মুখস্থ, বিভিন্ন আরবী কিতাব উর্দূ কিতাব বুঝতে পারা এতে করে আমার মেয়ের শিক্ষক আমিই হতে পারব ।
এগুলো ভাবলে হারানোর অনুভব হয় না
তবে এই ফাসাদের একটা বড় কারণ হল হিংসা এটা আমি নিজে নিজে খুজে বের করেছি তা হল আগে আমার হাজবেন্ড বাবা ভাইদের দোকান থেকে হার্ডওয়ারের মালামাল পাইকারি নিত । এরপর থেকে তারা আমার হাজবেন্ডের কাজ থেকে মালামাল পাইকারি নিত এই উন্নতি হয়ত সহ্য হয়নি সাদগ্রুপ অজুহাত মাত্র , বাকি এটা আমার ধারণা । বাস্তব আল্লাহু আলাম .....
/
রাঈসা মণি
আমার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আমার বয়স ছিল সারে পনের বছর, সদ্য এস এসসি পরিক্ষা দিয়েছি । তখনও রেজাল্ট বের হয়নি । পরিক্ষা শেষ ! স্বাধীন !! পড়াশুনার কোন চিন্তা নেই তাই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াতাম । কিন্তু এই স্বাধীনতা আর বেশিদিন থাকল না। আম্মু এসে বলল তোকে দেখতে আসবে তুই একটু রেডি হয়ে নে । আমি কথাটা শুনেই কান্না করতে করতে আম্মুকে বললাম আমি কলেজে উঠব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ব , আমার কত্ত স্বপ্ন আছে আর তোমরা সেগুলো সব শেষ করে দিবে , নাকি মেয়ে বলে তোমরা আমাকে বোঝা মনে কর তাই আপদ বিদায় করছ ?
কথাটা শুনে আম্মুও কেঁদে ফেললেন ।
আমার আব্বু একজন খুবই ধার্মিক মানুষ তাবলীগ করেন । বেশ কয়েকটা দেশে চিল্লাও দিয়েছেন । প্রতি বছর উমরা করেন ।
আব্বু এসে বললেন "শুনো মা ! আমি সব সময় তোমাদেরকে আমার জান্নাত মনে করি কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামতো মেয়েদের ব্যাপারে এমনটাই বলেছেন । জান্নাতকে কখনও কেউ বোঝা করে বলো ?
আর যে ছেলেটার সাথে তোমার বিয়ে দিতে চাচ্ছি তাকে আমি ছোট থেকেই মনে মনে পছন্দ করে রেখেছি আমার তিন মেয়ের কোন একজনকে দিব । এটা তোমার ভাগ্য যে তিনজনের মধ্যে তুমিই উপযুক্ত হয়েছ তার জন্য । বললাম আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে তুমি বলে দাও আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে ।
আব্বু বললেন কেন অপেক্ষা করতে বলব ; ওরা কি তোমাকে আগে থেকে পছন্দ করে রেখেছে, নাকি ওরা প্রস্তাব দিয়েছে ? ছেলেটা বিবাহ করবে শুনে আমিই প্রস্তাব দিয়েছি । বয়স মাত্র বিশ বছর সবে মাওলানা শেষ করল ...
আব্বুকে অনেক ভালবাসি তাই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলাম আর ছেলেরও পছন্দ হয়েছে আমাকে...
বাসর ঘরে বসে আছি আর ভাবছি টিভিতে দেখেছি মেয়েদের বাসর কত্ত সুন্দর হয় চারপাশে ফুল দিয়ে সাজানো থাকে বিছানায়ও ফুল থাকে মেয়েটা ফুলের মধ্যে বসে থাকে আরও কত্ত কি ...
কিন্তু আমি বসে আছি মশারির মধ্যে ।
মানুষের বিয়েতে গায়ে হলুদ তেলোই মেলোই নানা রকম আনন্দ ফুর্তি হয় সে সবতো কিছুই হলো না । আর এগুলো না হওয়ারই কথা কারণ আব্বু বলেন এগুলো মুসলমানের শান না ।
বিভিন্ন ধরনের কথা ভাবছি আর খুব ভয় পাচ্ছি । কিন্তু কেন ভয় পাচ্ছি তা জানি না ,খুবই অস্বস্তি আর বিরক্তবোধ করছিলাম ।
কিছুক্ষন পর রুমে সালাম দিয়ে ঢুকল, কপালের সামনের চুল ধরে দোয়া পড়ল ...
বিভিন্ন নসিহত করতে লাগল যা আজও আমার কানে বাজে ( কয়েকটা উল্লেখ করি )
" শুনো আমরা অনেকেই বিবাহ করি প্রাকৃতিক কারণে এবং মা ও বাবা হই প্রাণী জগতের সাড়া দিয়ে । শুনতে কষ্টকর হলেও এটাই সত্য এবং এটাই তিক্ত সত্য ।
মহৎ কোন চিন্তা ও চেতনাকে সামন রেখে , উম্মাহর সুসমৃদ্ধি ও বিস্তারের মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পবিত্রতার ছায়ায় দাম্পত্য জীবন অর্জন করা উচিত । ভালো করে মনে রাখবে মাতৃত্ব যদি হয় শুধু প্রসববেদনার নাম, পিতৃত্ব যদি শুধু... তাহলে প্রাণী জগতের পিতা-মাতা আর মানব পিতা-মাতার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই ।
একজন সুস্থ মস্তিষ্কের নারী কখনও তার সৌন্দর্য প্রদর্শণ করে রাস্তায় বের হয় না বরং পর্দায় আবৃত থাকাই তার আভিজাত্য ।
মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে অনেক সময় লাগে কিন্তু ভেঙ্গে যেতে এক মূহর্তও সময় লাগে না ...
(কথাগুলো এখনও আমার জীবন পথের পাথেয় হয়ে আছে)
কথাগুলো শুনে তখন মনে খুব ভালবাসা জন্ম নিল খুব দেখতে ইচ্ছে করল ; তাঁর দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলি । আবার তাকালাম আবার হল ,আবার তাকালাম আবারও ... বেশ কয়েকবার এমন হল । পরে বলল আচ্ছা আমি চোখ বন্ধ করি তুমি তাকাও...
বিয়ের এক সপ্তাহের পরই মোঃপুরে দুই রুমের একটা বাসা ভাড়া করে চললাম নতুন এক জীবনের দিকে । রান্না বান্না বলতে কিছুই করতে জানতাম না । কিভাবে মাছ মাংস কাটে তাও জানতাম না । কোন অংশ খায় আর কোন অংশ ফেলে দেয় তাও জানতাম না । আম্মুর কাছ থেকে ফোন করে করে জানতাম । তিনি বাসায় আসলে ইউটিউবে সার্চ দিতাম কিভাবে মাছ, মাংস কাটতে হয় , রান্না করতে হয় 😇😇😇
রান্না খেয়ে বলত বাহ্ অনেক চমৎকার হয়েছে এজন্য এর পুরস্কার হিসেবে তোমাকে শুক্রবার ঘুড়তে নিয়ে যাব । তাঁর প্রশংসা আর উৎসাহ শুনে তখন সত্যিই নিজেকে খুব ভাল মানের একজন রাধুনি মনে করতাম । আসলে আমি এতটাই দক্ষ রাধুনি ছিলাম মাছ মাংসের কোন অংশ খায় না খায় এই সন্দেহে বড় বড় মাছেরও মাথা ফেলে দিতাম আর মুরগির মাংসটুকু ছাড়া সবই ফেলে দিতাম ।
এরই মধ্যে রেজাল্ট বের হল A+ পেয়েছি শুনে খুব খুশি হলাম আর মনে মনে ভাবলাম তিনি কি আমাকে কলেজে ভর্তি করবে ? একজন আলেমের বউ এভাবে কলেজে পড়বে তিনি কি মানবেন । কলেজে ভর্তির কথা বলব কি বলব না খুব চিন্তায় ছিলাম
একদিন এসে বললেন:
তোমার বাবা বলেছেন তুমি নাকি পড়াশুনার প্রতি খুব মনোযোগী । তাহলে তোমার দ্বারাই কাজ হবে আর তোমার ব্রেন্ডও ভাল আছে তাহলে আমার আশাটা পূর্ণ হবে ...
( মনে মনে খুব খুশি হলাম মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি )
তবে কোন কলেজ ভার্সিটিতে না বরং তোমাকে আমি এমন এক জিনিস উপহার দিব তা তুমি কখনও ভাবতে পারবে না ।
একদিন মাগরিব পর ফুচকা আনল দুজনে খাচ্ছিলাম তখন আমাকে বলল "আচ্ছা আমাকে তুমি একটা সূরা শুনাও তোমার যেটা ইচ্ছা হয় "
আমি খুব লজ্জা পাই অনেক বলতে বলতে সূরা ফাতিহা শুনাই ।
বাহ তোমার কন্ঠতো অনেক সুন্দর । মেয়ে মানুষ তো তাই হয়ত ঠিক না ...
আমি মনে মনে খুব খুশি হলাম । লজ্জায় মাথা নিচু করে মুচকি মুচকি 😊 হাসছি । পরে আবার বললেন
আচ্ছা তুমি কি আমাকে সূরাটা আবার শুনাবে এবং সাথে আরও দুটো সূরা যাতে আমি রেকর্ড করে রাখতে পারি । আমি চোখ বন্ধ করে শুনাই আর তিনি ভিডিও করে রাখেন ।
পরের দিন সন্ধায় একটি কয়দা এনে বলল "শুন ভালোরও একটা ভালো আছে , তোমার পড়া , কন্ঠ , লাহান সবই সুন্দর তবে একটু শুদ্ধ হলে আরও ভাল হবে"
শুরু হল এক নতুন অধ্যায় ! আরবী হরফের মশক করাচ্ছে । মুখ হা করতে বলে তারপর তার আঙ্গুল দিয়ে বলে এই হরফটা দাতের এখানে লাগবে এটা সেখানে লাগবে। কিন্তু আমার কাছে খুবই লজ্জা লাগত । মাথা নিচু করে মাথা বালিশের ভিতর গুজে রাখতাম । তিনি কিছু বলতেন না ।
এভাবে কিছুদিন করার পর লজ্জা ভেঙ্গে গেলেও চোখ খুলতাম না বরং বন্ধ রেখেই মশক করতাম ।
উচ্চারণ সহীহ হল তাজবীদগুলোও মুখস্থ করার পর নাজেরা তারপর শুরু হল আরেক জীবন । মুখস্থ করতে বলল । কিন্তু মুখস্থ কি এত্ত সোজা । আমি স্কুল জীবনে ২৫ টিরও বেশি বড় বড় ইংলিশ রচনা মুখস্থ করেছি , এখনও মুখস্থ আছে । কিন্তু কুরআন মুখস্থ করতে গেলে ঘুম আসে শরীর খুব ক্লান্ত লাগে ।
কিন্তু তিনি হাল ছাড়তেন না । বরং বাচ্চাদের মত আদর করত মাথায় হাত বুলিয়ে দিত ঘুরতে নিয়ে যেত । এভাবে ৩০ নাম্বার পারা মুখস্থ হলে খুব আনন্দ লাগল ।সেও আমার সাথে তাল মেলাতে লাগল মিষ্টি আনল ঘুরতে নিয়ে গেল আসলে এগুলো ছিল তার উৎসাহ দেয়া । সাত দিন পর আরও চার পারা মুখস্থ হলে আর ভাল লাগল না । কিছুতেই মুখস্থ করতে মন চাইত না ।
যখন আট পারা হয়েছে তখন আল্লাহ তায়ালা এক নেয়ামত দান করেন । কেনসেপ করি । খুব ইচ্ছা ছিল বাচ্চা হওয়ার আগেই হাফেজা হব কিন্তু সেই ইচ্ছা আর পূরণ হল না । তিনি বলতেন এখন মুখস্থ করতে হবে না বরং আগেরগুলোই তেলাওয়াত কর , বেশি বেশি তেলাওয়াত করলে শয়তান আমাদের সন্তানকে কোন আছর করতে পারবে না ।
এই সময় কত্ত কষ্ট হয় তাতো আপুরা জানই তারপরও মুখস্থ করতে থাকি । ২২ পারা হয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরই আর রক্ষা হল না, আল্লাহ আমাকে একজন সুস্থ সবল সুন্দর একটি সন্তান দান করেন ।
বাবুর যখন তিন মাস বয়স তখন বাকি ৮ পারা শেষ হয় । খুশি কাকে বলে সেটা হাফেজা না হলে বুঝতাম না ।কে দেখে আমার খুশি , তিনি বাসায় আসলে খুব জোড়ে জড়িয়ে ধরি । এতই খুশিই ছিলাম যে তার বুক চোখের পানিতে ভিজিয়ে দিয়েছিলাম । মানুষ যে খুশিতে কাঁদে সেটাও বুঝলাম ।
( কিন্তু এত সুখের পরও আমার সংসারে নামে এক কালো ছায়া , আসলে সুখের পরে দুঃখ আসে ! আচ্ছা এটা পরেই বলি )
আমি হাফেজা হয়েছি শুনে আব্বু আম্মু বড় ভাইয়া দুই বোন, ভাবি , তিন চাচা এবং ছোট মামা আসেন । কেউই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না । আসলে কি আমার বংশে আমিই হলাম প্রথম কেউ যে হাফেজ । ছোট ভাইও হাফেজ তবে সে তিন বছর আগে হয়েছে ।
অবসর সময় ইউটিউব থেকে হাফেজ ইদ্রিস আল-হাসেমী এবং তহা আল-জুনায়েদ এই দুইজেনর তেলাওয়াত শুনি তাদের কন্ঠও হুবহু নকল করতে পারি । বাংলায় সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন । শুনলে আসলে পাগল পারা হয়ে যাবেন এত্ত চমৎকার কন্ঠ ওদের । কয়েকদিন পর আমার হাজবেন্ড বলল "কুরআন মুখস্থ করেছ এবার কুরআনের ভাষাটা শিখবে না ? হাদীসের ভাষা শিখবে না ?
আমি খুশি মনেই রাজি হয়ে যাই । শুরু হল জীবনের আরেক ধাপ । চলছে চলছে কিছুদিন পর আল্লাহ আরেক নেয়ামত দান করেন । কনসেপ করি । গর্ভকালীন সব সময় কুরআন তেলাওয়াত করতাম যাতে বাচ্চাকে শয়তান আছর না করতে পারে । খুব সুন্দর কিউট একটা সুস্থ সবল সন্তান হয় ।
ভালই দিন যাচ্ছিল ! এরপর সংসারে আসলো এক কালো ছায়া 😥😥😥 !! যাকে বলে সুখের পরে দুঃখ আসে ।
তাবলীগ নিয়ে বিশ্বব্যাপি দুটি দল তৈরি হল সাদ গ্রুপ আর আলেম গ্রুপ । আব্বু , তিন চাচা , মামা, এবং বড় ভাই এরা হল সাদ গ্রুপ । আমার আর বড় বোনের হাজবেন্ড হল আলেম গ্রুপ । যদিও বড় বোনের হাজবেন্ডকে নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই সব ব্যাথা আমার জনকে নিয়েই । তারও একটা কারণ আছে , বড় বোনের হাজবেন্ড আলেম না ।
এই মতপার্থক্য যে এতবড় রূপ নিবে কেউই জানতাম না । আমাকে কলা-কৌসলে বাবার বাড়ি নিয়ে যায় । এবং স্বামীকে ডিভোর্স দিতে বলে । তার কারণ একটাই যদি সে তাদের সাথে যোগ দেয় তাহলে আমাকে যেতে দিবে আর না হয় আমাকে আরেক জায়গায় ভাল ছেলে দেখে বিবাহ দিবে । ওই ভন্ড ছেলের সাথে আমাকে কিছুতেই আর ফেরত দিবে না । যোগাযোগ সব বিচ্ছিন্ন বাসায় একটা ফোন রাখে নাই এমনকি বাহিরে যাওয়ারও সুযোগ নেই কারণ বাহির থেকে তালা মারা থাকত । রাতে ভিতর থেকে তালা মারা থাকত ।
দাবি শুধু ওই একটাই ! খুব কাঁদতাম । এরই মধ্যে আরেক নেয়ামত লাভ করি ।
আমি গর্ভবতি শুনে মনে হল আব্বু তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে । আমাকে বাচ্চাটা নষ্ট করার জন্য কঠোরভাবে আদেশ দেয় । শুনেতো আমার মাথায় আগুন ধরে গেল মনে হল , বললাম "এটা কি জারজ বাচ্চা যে নষ্ট করে ফেলব , নাকি আপনার অনুমতি লাগবে কখন বাচ্চা হবে , না হবে । আমার বাচ্চা আমি কি করব না করব এর অধিকার আপনি দেখাতে আসবেন না"
ওই দিকেরও কোন খোজ খবর নেই সেও কোন যোগাযোগ করতে পারছিল না । বাসায় কয়েকবার আসলে নিচ থেকেই অপমান করে পাঠিয়ে দিত ।
একদিন সন্ধায় আব্বু , তিন চাচা , বড় ভাই আর মামা একটা ছেলেকে নিয়ে আসে আমাকে দেখাতে । ছেলেটা আগে থেকেই রাজি ছিল কিন্তু আমাকে দেখে তার আগ্রহ যেন আরও কয়েকগুন বেড়ে গেছে । সে আমার দুই সন্তান ও গর্ভের বাচ্চাও মেনে নিবে বলে ওয়াদা দিয়ে গেছে ।
ছেলেটা চলে গেলে আমি বললাম তোমাদের এই স্বপ্ন কখনই পূরণ হবে না । আমি জীবনেও আমার স্বামী ছাড়া অন্য কারও কাছে যাব না । কথাটা শুনে বড় চাচা এমন এক গালি দেয় যেটা কখনই আশা করিনি কেউই আশা করেনি । লজ্জাজনক এক ভাষা । এখানে লেখারও হিম্মত নেই আমার ।
খুব কাঁদতাম আম্মুরও কিছু করার ছিল না ভাবিও অসহায় । বড় বোনের হাজবেন্ড আলেম গ্রুপ তাই তারাও এ বাসায় নিষিদ্ধ ।
একদিন সন্ধায় আব্বু বাসায় আসলে আমার বড় সন্তানটা নানা নানা বলে জড়িয়ে ধরে খুব জোড়ে এক চড় মারে । এখন ওর সাত বছর বয়স চলে এমন একটা চড় এখন পর্যন্ত আমিও মারিনি ওর বাবাও মারেনি । কারণ এমন কোন কাজ করে না যার জন্য বকা দিতে হবে , এটা আল্লাহর এক বিশেষ রহমত । হয়ত সেই সময় কুরআন পড়ার কারণে এটা দান করেছেন ।যাইহোক বাচ্চাদের মারলে চিৎকার দিয়ে কাঁদবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু ও চিৎকার না দিয়ে গালে হাত দিয়ে আব্বুর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আর দুই গাল বেয়ে পানি ঝড়ছে । তখন আমার কলিজাটা মনে হল ছিড়ে গেছে । ওকে জড়িয়ে ধরে নিরবে অশ্রু ঝড়াতে লাগলাম । আর দোয়তো করেই যাচ্ছি ।
প্রায় দের মাস হয়ে গেল নতুন এক ফন্দি করলাম কিছুদিন চুপ হয়ে গেলাম ।
মেডিকেল চেকাপ করতে হবে বলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা বললাম । বড়ভাই সাথে যাবে শুনে বললাম আপনার লজ্জা করে মহিলাদের বিষয়ে আপনি নাক গলাচ্ছেন । আমার সাথে আফিফা (ছোট বোন) যাবে ।
বাচ্চাদের বাসায় রাখতে বললে বললাম "ওদের বাসায় রাখলে আপনারা খুন করে ফেলবেন না এটার কি নিশ্চয়াতা ? সেদিন তো একজন এমন চড় দিছে যেটা বড়ড়াও সহ্য করতে পারবে না ।
দুটো সিএনজি নিলাম একটায় বড় ভাই আর আব্বু আরেকটায় আমরা তিনজন আর ছোট বোন । ড্রাইভার ভাইয়ের কাছ থেকে ফোন নিয়ে বললাম আমি আসছি বলে বের হতে বললাম । তোমার সাথে তোমার বন্ধুদের সাথে নিতে বললাম সাথে আব্বু বড় ভাইয়া আছে সেটাও বললাম ।
ড্রাইভার ভাইকে বললাম যে তারা আমাকে জোর করে আমার বাচ্চাটা নষ্ট করতে চায় কারণ তাদের কথা দুটি সন্তানের বেশি সন্তান ভাল না তাই আমার বাচ্চাটা নষ্ট করতে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে । কথাটা শুনে লোকটা রেগে বলল কয়টা বাচ্চা হইবে না হইবে এইডা বাপে কওয়ার কেডা...
আমার দেয়া ঠিকানায় লোকটা চলে আসছে পথে ওই সিএনজিটা বাধা দেয়ার অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু তার বিভিন্ন পথ জানা থাকায় কিছুই করতে পারেনি ।
গাড়ি থেকে নেমে দেখি উনি দাড়িয়ে আছেন । এত্ত এত্ত প্রশান্তি অনুভব করেছি, এত্ত এত্ত খুশি হয়েছি যেদিন হাফেজা হয়েছিলাম সেদিনের মত । আমি কেঁদেই ফেললাম কত দিন পর মুখটা দেখলাম । বাচ্চারা খুব খুশি আব্বু আব্বু করে কোলে উঠেছে আমার খুব ইচ্ছা হল ওকে জড়িয়ে ধরার জন্য মনে হল হারানো সম্পদ খুজে পেয়েছি।
আব্বু এসে বলল চল বাসায় চল । আমি বললাম যদি আপনি জোড়াজুড়ি করেন তাহলে আমি চিৎকার দিয়ে মানুষ জড়ো করে বলব আপনি ইভটিজিং কারি । এতে আমার কোন খারাপ লাগবে না । বরং আরও ভাল লাগবে যদি গণধোলাই দেয় ।
আব্বু আমাকে জীবনেও মেয়ে বলে পরিচয় দিবে না বলে চলে গেল ।
বাসায় এসে মনে হল আমি আমার রাজত্ব ফিরে পেয়েছি । মরুভূমিতে হারানো উটকে খুজে পেয়েছি । তার কোলে মাথা রেখে কানে কানে সুসংবাদটা দিলাম । ওদের সাথে খেলার আরেকজন সাথি আসছে শুনে খুব খুশি হয়েছে । বাচ্চারাও খুশি বাবাকে পেয়ে । প্রায় দের মাস পর শান্তিমত একটু ঘুমাতে পারলাম ।
আমার তৃতীয় বাচ্চাটার মুখের দিকে যখন তাকাই তখন নিজে নিজে খুব ভেঙ্গে পড়ি ; নিষ্পাপ বাচ্চাটা আজ কোথায় থাকত যদি তাদের কথা শুনতাম , কি হত ওই দুই বাচ্চার । বড়জনের দিকে তাকালে মনে পড়ে ঐ চড়টার কথা ,তখন পরম মমতার সাথে চুমু একে দেই ওর কোমল দুই গালে । বরের দিকে তাকালে মনে পড়ে সেই গালিটার কথা তখন সোহাগ নিয়ে আস্তে করে জড়িয়ে ধরি খুজে বেড়াই তাঁর বুকের মাঝে একটু শান্তি । ভুলে যেতে চাই সেই অতীতগুলো । কিন্তু অতীতই আমাকে ভুলতে চায় না ।
কেন জানি ছোটবাচ্চার আম্মু ডাকটা খুব মধুর লাগে । বড়জনের বয়স সাত বছর চলে ১৮ পারা মুখস্থ করিয়েছি । দ্বিতীয়জনকে ৩০ নাম্বার পারা মুখস্থ করিয়েছি । যদিও ও এখনও সবব হরফ উচ্চারণ করতে পারেনা তবুও ওর তোতলা তোতলা পড়াটা শুনতে খুবই ভাল লাগে ।
বাবার সাথে কোন যোগাযোগ নেই এজন্য কোন খারাপ লাগে না এটাই সত্যি ।
বয়স মাত্র সারে ২৩ বছর এর মধ্যে অনেক কিছু পেলাম আবার অনেক কিছু হারালামও ।
বাবা, ভাই, চাচা , মামাসহ আত্মিয়স্বজন । তবে যারা সত্যিকারের আত্মিয়স্বজন তারা ঠিকই খোজ খবর রাখে । তবে যেটা হারালাম এটাকে আপনারা হারানো বলবেন কিনা জানিনা তবে আমার কছে হারানো মনে হয় না । অর্জনের দিকে তাকালে বর্জনের কথা ভুলে যাই । বুকের মধ্যে ত্রিশ পারা কুরআন , তিনটি বাচ্চা , একজন প্রাণের মানুষ , কিছুদিন পর আরেক নাম যোগ হবে "আলেমা"
পুরো ত্রিশ পারা কুরআন বাংলায় বুঝতে পারি অসংখ্য মাসআলা মুখস্থ , হাদীস মুখস্থ, বিভিন্ন আরবী কিতাব উর্দূ কিতাব বুঝতে পারা এতে করে আমার মেয়ের শিক্ষক আমিই হতে পারব ।
এগুলো ভাবলে হারানোর অনুভব হয় না
তবে এই ফাসাদের একটা বড় কারণ হল হিংসা এটা আমি নিজে নিজে খুজে বের করেছি তা হল আগে আমার হাজবেন্ড বাবা ভাইদের দোকান থেকে হার্ডওয়ারের মালামাল পাইকারি নিত । এরপর থেকে তারা আমার হাজবেন্ডের কাজ থেকে মালামাল পাইকারি নিত এই উন্নতি হয়ত সহ্য হয়নি সাদগ্রুপ অজুহাত মাত্র , বাকি এটা আমার ধারণা । বাস্তব আল্লাহু আলাম .....
/
রাঈসা মণি
মন্তব্যসমূহ